পদ বা পদাবলি হচ্ছে বৈষ্ণবীয় ধর্মের গূঢ় বিষয়ের বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাস্য নামে খ্যাত বিশেষ সৃষ্টি একশ্রেণীর ধর্মসঙ্গীতের সংগ্রহ। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘বৈষ্ণব পদাবলি’।
বৈষ্ণব পদাবলি পুস্তকটি সংগ্রহ করেছেন বাবা আউল মনোহর দাস। বৈষ্ণব পদাবলি, রাধা ও কৃষ্ণের আকর্ষণ-বিকর্ষণের বিচিত্র অনুভূতি সম্বলিত এক প্রকার গান। বৈষ্ণবদের উপাস্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর আনন্দময় তথা প্রেমময় প্রকাশ ঘটেছে রাধার মাধ্যমে।
বৈষ্ণব পদাবলিতে পাঁচ প্রকারের রস আছে। যথা:- শান্ত রস, দাস্য রস, সখ্য রস, বাৎসল্য রস, মধুর রস। শান্তরসে ভক্ত কৃষ্ণকে ভগবান রূপে কল্পনা করেন। দাস্য রসে ভগবান ঐশ্বর্যশালী আর ভক্ত দীনমাত্র-ভক্ত নিজেই ভৃত্য সেজে ভগবান কৃষ্ণকে প্রভুরুপে মেনে নিয়ে তাকে সেবার মাধ্যমে এই রসের স্ফুরণ ঘটায়। সখ্য রসে ভক্ত ভগবানকে সখা রূপে কল্পনা করে তাকে সংগ দানের মাধ্যমে এই রসের স্ফুরণ ঘটায়। বাৎসল্য রসে ভক্ত ভগবানকে সন্তানরূপে কল্পনা করে তাকে পালন করে আর মধুর রসে গিয়ে কৃষ্ণ পুরোপুরি মানব রূপে ভক্তকুলের সঙ্গে মিশে যান। শ্রীকৃষ্ণের ও তার প্রেয়সীভাবাপন্ন ভক্তদের যে মধুর সম্বন্ধ এবং এই প্রিয় সম্বন্ধজনিত পরস্পরের মধ্যে যে সম্ভোগ ভাব তার নাম মধুর রস।
বৈষ্ণব পদাবলির পাঁচ প্রকারের রসের মধ্যে মধুর রসকেই শ্রেষ্ঠ রস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পদাবলিরকবি
বৈষ্ণব সমাজে বৈষ্ণব পদাবলি ‘মহাজন পদাবলি’ নামে এবং বৈষ্ণব পদকর্তাগণ ‘মহাজন’ নামে পরিচিত।
পদাবলির আদি কবি বিদ্যাপতি, তিনি ব্রজবুলি ভাষায় পদাবলির পদগুলো রচনা করেন।
বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলির আদি রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। তবে পদাবলির পদকর্তা হিসেবে জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, লোচনদাস, বলরামদাসের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
চতুর্দশ শতকের বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস এবং ষোড়শ শতকের গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাসকে বৈষ্ণব পদাবলির চতুষ্টয় বলা হয়।
পদকর্তা হিসেবে আধুনিকযুগের কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পদকর্তা জয়দেব
বার’শ শতকের সংস্কৃত কবি জয়দেবের বিখ্যাত রচনা ‘গীতগোবিন্দম্’ একটি সংস্কৃত গীতিকাব্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এই গীতিকাব্যের মুখ্য বিষয় এবং পরবর্তীকালে বাংলা পদাবলি সাহিত্যে এর গভীর প্রভাব পড়েছে।
পদকর্তা বিদ্যাপতি
বিদ্যাপতি চতুর্দশ শতকেরঅবাঙালি কবি। বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদাবলির গুরুস্থানীয় রচয়িতা। একটি বাংলা পঙক্তি না লিখেও তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত মর্যাদাবান কবি বলা হয়ে থাকে। বিদ্যাপতির অমর উক্তি-
এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মহা ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।
ব্রজবুলিভাষা
পদাবলির আদি কবি বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষার স্রষ্টা। বৈষ্ণব পদাবলির অধিকাংশ পদাবলিই রচিত হয়েছে ‘ব্রজবুলি’ নামক একটি কৃত্রিম ও মিশ্র ভাষায়। ব্রজলীলা সম্পর্কিত পদাবলির ভাষা-‘ব্রজবুলি,নামে পরিচিত। ব্রজবুলি ভাষা মূলত মৈথিলি ও বাংলা মিশ্রণে এক মধুর সাহিত্যিক ভাষা তবে এতে কিছু হিন্দি শব্দও আছে। ব্রজবুলি কখনও মানুষের মুখের ভাষা ছিল না; সাহিত্যকর্ম ব্যতীত অন্যত্র এর ব্যবহারও নেই।
চণ্ডীদাস
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চণ্ডীদাস তিন জন। বড় চণ্ডীদস ,দ্বিজ চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস। তাঁদের মধ্যে বড়ু চণ্ডীদাস সবচেয়ে প্রাচীন।
চণ্ডীদাসের অমর উক্তি-
১) সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
২) সই কে শুনাইল শ্যাম নাম।
৩) সই কেমনে ধরিব হিয়া
আমার বঁধূয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙিনা দিয়া।
৪) দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।
জ্ঞানদাস
ষোড়শ শতকে বর্ধমান জেলায় কবি তথা পদকর্তা জ্ঞানদাসের জম্ম। তিনি চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য ছিলেন তাই চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের পদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। জ্ঞানদাস ছিলেন শিল্পী এবং চণ্ডীদাস ছিলেন সাধক।
জ্ঞানদাসের বিখ্যাত পঙক্তি-
১) রুপ লগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
২) সুখের লাগিয়া এ ঘর বান্ধিলুঁ আনলে পুড়িয়া গেল।
গোবিন্দদাস
ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব পদকর্তা। জ্ঞানদাসের মতো তাঁকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলা হয়।