আলোচ্য বিষয় সমূহ- পাল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন, উত্থান ও পতনের ধারাবাহিক ইতিহাস, বাংলায় পাল শাসনামলে সংঘটিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ঘটানাবলি যেমন ত্রিশক্তি সংঘর্ষ, কৈর্বত্য বিদ্রোহ ইত্যাদির উপর প্রয়োজনীয় আলোকপাত এবং পাল সাম্রাজ্য থেকে বিভিন্ন পরীক্ষায় আসা প্রশ্নসমূহের আলোচনা।
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে গৌড় রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলা অঞ্চলে রাজ্য পরিচালনার মত কোনো কেন্দ্রীয় যোগ্য শাসক ছিল না ফলে এ অঞ্চলটিতে আবারও নৈরাজ্য ও অস্থিরতা দেখা দেয় এবং ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় এক শতক ধরে স্থানীয় গোত্রে-গোত্রে ও রাজায়-রাজায় লড়াই চলতে থাকে, যা পাল তাম্রশাসনে মাৎস্যন্যায় নামে উল্লেখিত আছে। পাল সাম্রাজ্যের পত্তনের মধ্য দিয়ে এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটে এবং বাংলা এক ঐতিহাসিক স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন শুরু হয়।
৭৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শতাব্দীব্যাপী চলা নৈরাজ্য ও অস্থিরতার অবসান ঘটাতে একদল সামন্তপ্রভু গোপালকে বাংলা অঞ্চলের শাসনকর্তা নির্বাচিত করেন। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সম্রাট হিসাবে গোপাল নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে পাল সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে। পাল রাজত্বের উত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলার অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটে। পালযুগকে বাংলার ইতিহাসের অন্যতম স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়। পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পাল রাজাদের পিতৃভূমি ছিল বরেন্দ্র।পাল শাসনামলে বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন শুরু হয় । পাল বংশের রাজারা একটানা চারশত বছর (খ্রিষ্টীয় ৭৫০ থেক খ্রিষ্টীয় ১১৬২) বাংলা শাসন করেন। এত দীর্ঘ সময় আর কোনো রাজবংশ বাংলা শাসন করেনি।
পাল বংশের প্রথম রাজা গোপালের পুত্র সম্রাট ধর্মপাল (৭৮১-৮২১ খ্রি.) এবং পৌত্র দেবপালের শাসনামলে পাল সাম্রাজ্য সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিল। পাল রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন ধর্মপাল এবং বিক্রমশীল ছিল তাঁর উপাধি। পঞ্চাশ বছর পূর্বে যে দেশ অরাজকতা ও অত্যাচারের লীলাভূমি ছিল, তাঁর নেতৃত্বে সেদেশ সহসা প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠে। ধর্মপাল উত্তর ভারত নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ‘পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। ধর্মপাল বৌদ্ধধর্মের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম বিকাশে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর মহাবিহার এবং বিক্রমশিলা মহাবিহারসহ আরও ৫০টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
পাল শাসনামল থেকে সর্বপ্রথম একজন প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান সচিবের উল্লেখ পাওয়া যায়-তিনিই ছিলেন সর্বপ্রধান রাজকর্মচারী। ধর্মপালের প্রধানমন্ত্রী গর্গ ছিলেন একজন ব্রাহ্মন।
ত্রিশক্তি সংঘর্ষঃ হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর উত্তর ভারতের কনৌজ দখলকে কেন্দ্র করে তিন শক্তির মধ্যে দ্বন্দ দেখা দেয় যা ইতিহাসে ত্রিশক্তি সংঘর্ষ নামে পরিচিত। এই তিন শক্তি হচ্ছে- ধর্মপালের নেতৃত্বে বাংলার পাল বংশ, প্রতিহার বংশ এবং দক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ।
বাংলা ভাষার ভিত্তি রচনা করেন পালরা। বাংলার প্রথম সাহিত্যকর্ম চর্যাপদ রচিত হয় পাল যুগে।
ধর্মপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবপাল (৮২১-৮৬১ খ্রিঃ) পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সিংহাসনে বসেন। তাঁর সময়েই পাল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছিল। দেবপালকে সবচেয়ে শক্তিশালী পাল শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেবপালের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সেই সময় সমগ্র এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের তথা বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রধান প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই তাঁর শাসনামলেই উত্তর ভারতে হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধধর্ম পুনরায় সজীব হয়ে ওঠে।
দেবপালের মৃত্যুর পর ৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পাল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে পতনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দেবপালের মৃত্যুর পর যোগ্য শাসকের অভাবে পাল সাম্রাজ্য উত্তর ও পূর্ব বাংলার কতৃত্ব হারিয়ে ফেলে এবং পাল সাম্রাজ্য গৌড়, রাঢ়, অঙ্গ ও বঙ্গ প্রভৃতি ছোটো ছোটো রাজ্য বিভাজিত হয়ে পড়ে। পালদের এই দুঃসময়ে বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপাল ৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণের তিন বছরের মধ্যেই তিনি উত্তর ও পূর্ব বাংলা পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
প্রথম মহীপালের মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময়ে একাধিক রাজ্যের আক্রমণের ফলে পাল সাম্রাজ্যের শক্তি অনেকটাই হ্রাস পায়। পরবর্তিতে তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০ খ্রি.) অল্প কিছুকালের জন্য পালেদের সামরিক গৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহীপাল এর শাসনামলে কৈবর্ত বিদ্রোহ হয়। পাল রাজাদের এক সামন্ত দিব্যর নেতৃত্বে কৈবর্তরা রাজ্যের বরেন্দ্রীয় অংশ দখল করে নেয়। কৈবর্ত বিদ্রোহের নেতা সামন্ত রাজা দিব্য দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করেন এবং বরেন্দ্র অঞ্চলকে সার্বভৌম ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় মহীপাল এর পর তার ভ্রাতা রামপাল সিংহাসনে বসে। রামপাল ছিলেন শেষ শক্তিশালী পাল সম্রাট। পরবর্তীতে রামপাল একাধিক সামন্ত রাজার সাহায্যে কৈবর্ত বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন ও বরেন্দ্র অঞ্চল পুনর্দখল করেন। তিনি কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন।
অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা পাল যুগের প্রাচীন তালপাতার উপর অংকিত রঙিন পুঁথিচিত্র নিদর্শন। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এ পুথির লিপিকার শিলাদিত্য। আট হাজার পংক্তির এ পুঁথি রচিত হয় একাদশ শতকের শেষদিকে রাজা হরিবর্ম দেবের ১৯তম রাজ্য বৎসরে। পুঁথিটির ৫৩১ টি পাতার মধ্যে ৫১৯ টি পাতা বর্তমানে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
কৈবর্ত বিদ্রোহ দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০ খ্রি.) এর শাসনামলে বরেন্দ্র অঞ্চলে সংঘটিত ভারতবর্ষের প্রথম সফল জনবিদ্রোহ। বাংলার চাষী, কৃষক ও জেলেদের সমন্বয়ে সংঘটিত এ বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিল পাল রাজাদের এক সামন্ত দিব্য। পরবর্তিতে তৎকালীন বরেন্দ্র অঞ্চলীয় সামন্তদের একটি বড় অংশ এই বিদ্রোহে যোগ দেওয়ায় এটি বরেন্দ্র বিদ্রোহ বা সামন্ত বিদ্রোহ নামেও পরিচিত হয়। দিব্যর নেতৃত্বে কৈবর্তরা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করেন এবং রাজ্যের বরেন্দ্রীয় অংশ দখল করে একে স্বাধীন বরেন্দ্রীয় রাস্ট্র হিসেবে ঘোষনা করে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় মহীপালের পর তার ভ্রাতা রামপাল একাধিক সামন্ত রাজার সাহায্যে বরেন্দ্র অঞ্চল পুনর্দখল করেন এবং কৈবর্ত বিদ্রোহের নেতা সামন্ত রাজা দিব্যর পৌত্র ভীমকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে কৈবর্ত বিদ্রোহ দমন করেন।
মদনপাল (১১৪৩-১১৬২ খ্রি.) ছিলেন পাল বংশের সর্বশেষ রাজা। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ধ্যাকর নন্দী সংস্কৃত কাব্য ‘রামচরিতম’ (বাংলা রামচরিত) রচনা করেন।
খ্রিস্টীয় ১২শ শতকে হিন্দু সেন রাজবংশের পুনরুত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। বারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিজয়সেন পাল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাংলায় সেন বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এর সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের শেষ বড় বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা পাল যুগের প্রাচীন তালপাতার উপর অংকিত রঙিন পুঁথিচিত্র নিদর্শন। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এ পুথির লিপিকার শিলাদিত্য। আট হাজার পংক্তির এ পুঁথি রচিত হয় একাদশ শতকের শেষদিকে রাজা হরিবর্ম দেবের ১৯তম রাজ্য বৎসরে। পুঁথিটির ৫৩১ টি পাতার মধ্যে ৫১৯ টি পাতা বর্তমানে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
কৈবর্ত বিদ্রোহ
কৈবর্ত বিদ্রোহ দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০ খ্রি.) এর শাসনামলে বরেন্দ্র অঞ্চলে সংঘটিত ভারতবর্ষের প্রথম সফল জনবিদ্রোহ। বাংলার চাষী, কৃষক ও জেলেদের সমন্বয়ে সংঘটিত এ বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিল পাল রাজাদের এক সামন্ত দিব্য। পরবর্তিতে তৎকালীন বরেন্দ্র অঞ্চলীয় সামন্তদের একটি বড় অংশ এই বিদ্রোহে যোগ দেওয়ায় এটি বরেন্দ্র বিদ্রোহ বা সামন্ত বিদ্রোহ নামেও পরিচিত হয়। দিব্যর নেতৃত্বে কৈবর্তরা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করেন এবং রাজ্যের বরেন্দ্রীয় অংশ দখল করে একে স্বাধীন বরেন্দ্রীয় রাস্ট্র হিসেবে ঘোষনা করে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় মহীপাল এর পর তার ভ্রাতা রামপাল একাধিক সামন্ত রাজার সাহায্যে বরেন্দ্র অঞ্চল পুনর্দখল করেন এবং কৈবর্ত বিদ্রোহের নেতা সামন্ত রাজা দিব্যর পৌত্র ভীমকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে কৈবর্ত বিদ্রোহ দমন করেন।