আলোচ্য বিষয় সমূহ- সেন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন, উত্থান এবং পতনের ধারাবাহিক ইতিহাস, সেন সাম্রাজ্য থেকে বিসিএস, পিএসসি এর বিভিন্ন চাকুরীর পরীক্ষা ও ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় আসা প্রশ্ন সমূহের আলোচনা।
পাল শাসনামলের তাম্রশাসনগুলো থেকে জানা যায় দেবপাল থেকে মদনপাল প্রায় সকল পাল সম্রাটই তাদের প্রশাসনিক কাজে বিদেশী কর্মচারীদের নিয়োগ করতেন। ধারণা করা হয় সেই সময় সেনরা কর্নাটক থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে বাংলায় সেন রাজ বংশের গোড়াপত্তন খ্রিষ্টীয় ৯০০ শতকের পূর্বে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন বাংলায় সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সামন্ত সেন পাল রাজাদের একজন মহান সামন্ত বা সামন্ত রাজা ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কোনো এক অংশ নিজের কারায়ত্ত করেন। সামন্ত সেন অবশ্য রাজা উপাধি ধারণ করেননি। তাঁর পুত্র হেমন্ত সেন স্বাধীন সেন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথম ‘মহারাজা’ উপাধি গ্রহণ করেন।
সেন সাম্রাজ্য উত্থান
পাল আমলে বাংলায় বংশানুক্রমিক শাসনের যে সুত্রপাত হয়েছিল তা সেন শাসনামলেও বজায় ছিল। হেমন্ত সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিজয় সেন (১০৯৮-১১৬০ খ্রি.) সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিজয় সেন ছিলেন সেন বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা।তিনিই সম্ভবত সামন্তরাজা থেকে নিজেকে স্বাধীন রাজারুপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কৈবর্ত বিদ্রোহের সময় তিনি পাল রাজা রামপালকে সাহায্য করেন এবং বরেন্দ্র উদ্ধারে রামপালকে সাহায্য করার বিনিময়ে বিজয়সেন স্বাধীনতার স্বীকৃতি পান। শেষ পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিজয় সেন মদন পালকে পরাজিত করে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা থেকে পালদের বিতাড়িত করে নিজ প্রভুত্ব বিস্তার করেন। পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলার জাতীয় ঐক্য ভেঙ্গে যায়। বিজয় সেন বাংলাকে একটি রাজ্য হিসেবে পুনঃসংযুক্ত করেন। তিনি ছোট সেন রাজ্যকে বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। তিনি সমগ্র বাংলা, গৌড়, মিথিলা ও পূর্ববঙ্গ জয় করেন। এরপর তিনি কামরুপ, কলিঙ্গ ও মিথিলা আক্রমণ করেন। হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে অবস্থিত বিজয়পুর ছিল বিজয় সেনের প্রথম রাজধানী। আর তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করা হয় বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে।
বিজয় সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮ খ্রি.) সিংহাসনে আরোহণ করেন। বল্লাল সেন বাংলায় সামাজিক সংস্কার বিশেষ করে কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন পণ্ডিত ও লেখক। “দানসাগর” এবং “অদ্ভুতসাগর” তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। অবশ্য “অদ্ভুতসাগর” গ্রন্থটির অসমাপ্ত অংশ তাঁর পুত্র লক্ষণ সেন সম্পূর্ন করেছিলেন। বল্লাল সেন বৃদ্ধ বয়সে তাঁর ৬০ বছর বয়সী পুত্র, লক্ষণ সেন এর হাতে সিংহাসন অর্পন করেন এবং ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গার তীরে স্ত্রী সহ শাস্ত্রচর্চা করে তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত করেন।
সেন সাম্রাজ্যের পতন
লক্ষণ সেন (১১৭৮-১২০৬ খ্রি) ছিলেন সেন বংশের সর্বশেষ স্বাধীন রাজা। লক্ষণসেন রাজত্বের প্রথমদিকে যথেষ্ঠ সামরিক প্রতিভার পরিচয় দেন এবং সমগ্রবাংলায় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ‘গৌড়েশ্বর’উপাধি ধারণ করেন। কিন্তু তার রাজত্বের শেষ দিকে সেন সাম্রাজ্য ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো একে একে তুর্কিদের হাতে দখল হতে থাকে এবং ক্রমে তুর্কিরা বাংলাই প্রবেশ করতে থাকে। তবাকাত -ই- নাসিরী গ্রন্থের বর্ননা থেকে জানা যায় ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে (ত্রয়োদশ শতাব্দীতে), আফগানিস্তানের অধিবাসী ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি আরব অশ্ব বিক্রেতার ছদ্মবেশে মাত্র ১৮ জন অশ্বরোহী নিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। বখতিয়ার খলজী অনেক দূরদর্শী ও সাহসী সেনাপতি ছিলেন। বাংলায় অভিযানের পূর্বেই তিনি বাংলার অভ্যন্তরীণ অবস্থা, রক্ষাব্যবস্থা ও বাংলায় প্রবেশের বিভিন্ন পথ সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন। তিনি বাংলার প্রবেশের সহজ পথ বর্জন করে দুর্গম পাহাড়ের পথ দিয়ে গয়া ও ঝাড়খন্ডের মধ্য হয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। লক্ষ্মন সেনের নদীয়ার প্রসাদের সম্মুখে বিনা বাধায় উপস্থিত হয়ে তিনি প্রাসাদ রক্ষীদের হত্যা করা শুরু করেন। রাজা লক্ষ্মনসেন এ সময় মাধ্যাহ্নভোজনে বসেছিলেন। এই সময় প্রাসাদে শোরগোল ও উচ্চকন্ঠে আর্তনাদ শুনে রাজা লক্ষণসেন ভীত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে জ্যেতিষী পন্ডিদদের তুর্কি জাতি কর্তৃক বঙ্গ অভিযান ও দখল করার ভবিষ্যদ্বানী তাকে ভীত করে তোলে। বৃদ্ধ লক্ষণ সেন কোন প্রতিরোধ না করেই নদীয়া থেকে নদী পথে পালিয়ে পূর্ববঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে রাজা লক্ষ্মণসেনের বিপুল ধনসম্পদ ও বহুসংখ্যক হাতি বখতিয়ার খলজী হস্তগত হয়। ফলশ্রুতিতে বখতিয়ার খলজি বিনা বাঁধায় উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা সহজেই অধিকার করে নেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। এরই মধ্যে নদীয়ায় বখতিয়ার খলজীর পেছনে থাকা সৈন্য বাহিনী তার সাথে যোগ দেয়। বখতিয়ার খলজি ১২০৫ সালে সেনদের অন্যতম রাজধানী লক্ষনাবতী (গৌড়) অধিকার করেন। এ সময় থেকেই লক্ষণাবতীর নাম হয় লখনৌতি। লক্ষণাবতীকে (গৗড়) কেন্দ্র করে বাংলায় মুসলিম সাম্রজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেন রাজাদের সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে তাঁরা বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্য শাসন করতে থাকে। লক্ষণ সেনের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরুপ সেন (১২০৬-১২২৫ খ্রি.) ও কেশব সেন (১২২৫-১২৩০ থ্রি) কিছুকাল পূর্ব বাংলা শাসন করেন। প্রকৃতপক্ষে লক্ষণ সেনের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় সেন শাসন তথা হিন্দু রাজাদের শাসনের অবসান ঘটে।