উয়ারী বটেশ্বর বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম প্রত্নতাত্বিক স্থান যেখানে বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। উয়ারী ও বটেশ্বর গ্রাম দুইটি নরসিংদীর জেলার বেলাব উপজেলায় অবস্থিত। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত উয়ারী বটেশ্বর ছিল প্রাচীন গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যের অংশ প্রাচীনতম দূর্গ নগরী। এই প্রাচীনতম দূর্গ নগরীটি গড়ে উঠেছিল প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বা খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ থেকে ৫০০ অব্দে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রত্নতাত্বিকদের অনেকেই উয়ারি বটেশ্বরকে টলেমির ‘সৌনাগড়া’ বলে উল্লেখ করে থাকেন।
১৯৩০ সালের দিকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব মোহাম্মদ হানিফ পাঠান প্রথম উয়ারি বটেশ্বরকে সুধী সমাজের নজরে আনেন। ২০০০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ব বিভাগের উদ্যোগে শুরু হয় এর প্রথম খনন কাজ যার নেতৃত্বে ছিলেন বিভাগের প্রধান সুফী মোস্তাফিজুর রহমান। এখানে প্রাপ্ত নিদর্শন গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গ-নগর, রাস্তা, পার্শ্ব রাস্তা, পোড়ামাটির ফলক, কাঁচের পুতি,মূল্যবান পাথরসহ উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা। ২০১০ সালে এখানে আবিস্কৃত হয়েছে ১৪০০ বছরের প্রাচীন ইট নির্মিত বৌদ্ধ পদ্মমন্দির।
বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিস্কৃত হয়েছে উয়ারী ও বটেশ্বর এ।
মহাস্থানগড়
মহাস্থানগড় বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। এটি বগুড়া শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। মহাস্থানগড়ের পুরাতন নাম পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর যা ছিল বাংলার প্রাচীনতম জনপদ পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী এবং পুণ্ড্রদের আবাসস্থল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই নগর গড়ে উঠেছিল। এটি প্রাচীনকালে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজবংশের রাজাদের প্রাদেশিক রাজধানী ছিল।
১৮০৮ সালে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টন সর্বপ্রথম এ স্থানটি আবিস্কার করেন। ১৮৭৯ সালে বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম স্থানটিকে প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনের ধ্বংসাবশেষ ও রাজধানী হিসাবে সনাক্ত করেন।
২০১৬ সালে মহাস্থানগড়কে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
মহাস্থানগড়ের প্রথাগত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ ১৯২৮-২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শুরু করা হয়। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সন্ধান মেলে ব্রাহ্মী লিপির, যা বাংলার প্রাচীনতম শিলালিপি এবং এই শিলালিপিটি মৌর্যযুগের। এখানে রয়েছে সম্রাট অশোক নির্মিত বৌদ্ধ স্তম্ভ যা বেহুলার বাসর ঘর নামে পরিচিত। মাহাস্থানগড়ের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- শাহ সুলতান বলখীর মাজার, পরশুরামের প্রাসাদ, বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, লক্ষ্ণীন্দরের মেধ, কালীদহ সাগর, শীলাদেবীর ঘাট, পদ্মাদেবীর বাসভবন ইত্যাদি।
শাহ সুলাতান বলখী (র:) ১৪শ শতাব্দির একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক ছিলেন।কথিত আছে মাছ আকৃতির নৌকাতে করে তিনি তার শীষ্যদের নিয়ে বরেন্দ্রভূমিতে আসেন এবং ধর্ম প্রচার করেন।
ময়নামতি
ময়নামতি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। ময়নামতির পূর্ব নাম রোহিতগিরি। বর্তমান ময়নামতি অঞ্চলে যে ধ্বংশস্তুপ দেখা যায় তা প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ ও বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশ। এ স্থানের নামকরণ করা হয় রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী রানী ময়নামতি নামানুসারে।
ময়নামতি প্রত্নস্থল, লালমাই অঞ্চলের আবিষ্কৃত প্রত্নস্থল সমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন।ময়নামতি ছিল প্রাচীন বঙ্গ সমতটের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র।
কুমিল্লার ময়নামতিতে খননকৃত সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম প্রধান। এ বৌদ্ধ বিহারটির অবস্থান কোটবাড়িতে বার্ডের কাছে লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায়। ধারণা করা হয় দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন।
খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ থেকে ১২’শ পর্যন্ত এই পুরো অঞ্চল ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এই বৌদ্ধবিহারটি ছিল আবাসিক শিক্ষায়তন এবং এর আসল নাম ছিল ভবদেব বিহার। সারা ভারতের বৌদ্ধ সংস্কৃতির সর্বশেষ শিখা এখানেই জ্বলেছিল। এখানকার পণ্ডিতদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল চীন পর্যন্ত তাই সপ্তম শতাব্দীতে সুদূর চীন থেকে বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাং এই কুমিল্লার লালমাইয়ের কোনো এক বৌদ্ধবিহারে এসেছিলেন, ।
এখানকার উল্লেখযোগ্য অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো হল- লালমাই পাহাড়, কুটিলা মুড়া, ইটখোলা মুড়া, রপবান মুড়া, চারপত্র মুড়া ইত্যাদি। ময়নামতীর মনুমেন্টগুলির মধ্যে আনন্দবিহার সর্ববৃহৎ। এটি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভারে সমৃদ্ধ কোটবাড়ির কেন্দ্রে অবস্থিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহনকারী আটটি তাম্রলিপি, চারশরও অধিক স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি বা ঐতিহাসিক নিদর্শন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদের কবরস্থান। বাংলাদেশে মোট দুটি কমনওয়েলথ রণ সমাধিক্ষেত্র আছে, যার অপরটি চট্টগ্রামে অবস্থিত।
পাহাড়পুর
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারটি বাংলাদেশের বৃহত্তর বিহার। ইউনেস্কোর মতে পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বৌদ্ধ বিহার ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার এবং আয়তনে এর সাথে শুধুমাত্র ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষের দিকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।
বুকানন হ্যামিল্টনের জরিপ অনুযায়ী, ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন। সত্যপীরের ভিটা সোমপুর বিহারের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। ইউনেস্কো ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে।
সোমপুর বিহার ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, বরং চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। খ্রিস্টীয় দশম শতকে সোমপুর বিহারের আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর।
উয়ারী বটেশ্বর বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম প্রত্নতাত্বিক স্থান যেখানে বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
উয়ারী বটেশ্বর কোথায় অবস্থিত?
উয়ারী ও বটেশ্বর গ্রাম দুইটি নরসিংদীর জেলার বেলাব উপজেলায় অবস্থিত।
মহাস্থানগড়
মহাস্থানগড় বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। এটি বগুড়া শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। মহাস্থানগড়ের পুরাতন নাম পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর যা ছিল বাংলার প্রাচীনতম জনপদ পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী এবং পুণ্ড্রদের আবাসস্থল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই নগর গড়ে উঠেছিল। এটি প্রাচীনকালে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজবংশের রাজাদের প্রাদেশিক রাজধানী ছিল।
ময়নামতি
ময়নামতি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। ময়নামতির পূর্ব নাম রোহিতগিরি। বর্তমান ময়নামতি অঞ্চলে যে ধ্বংশস্তুপ দেখা যায় তা প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ ও বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশ। এ স্থানের নামকরণ করা হয় রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী রানী ময়নামতি নামানুসারে। কুমিল্লার ময়নামতিতে খননকৃত সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম প্রধান। এ বৌদ্ধ বিহারটির অবস্থান কোটবাড়িতে বার্ডের কাছে লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায়। ধারণা করা হয় দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন।
পাহাড়পুর
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারটি বাংলাদেশের বৃহত্তর বিহার। ইউনেস্কোর মতে পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বৌদ্ধ বিহার ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার এবং আয়তনে এর সাথে শুধুমাত্র ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষের দিকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।